ঢাকা , সোমবার, ০৪ অগাস্ট ২০২৫ , ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংসার ও স্বপ্নের ভার কাঁধে নিয়ে চা-কফি বিক্রি করে এগিয়ে চলেছে কলেজ ছাত্র উজ্জ্বল।


আপডেট সময় : ২০২৫-০৮-০৩ ২২:১৮:২৪
সংসার ও স্বপ্নের ভার কাঁধে নিয়ে চা-কফি বিক্রি করে এগিয়ে চলেছে কলেজ ছাত্র উজ্জ্বল। সংসার ও স্বপ্নের ভার কাঁধে নিয়ে চা-কফি বিক্রি করে এগিয়ে চলেছে কলেজ ছাত্র উজ্জ্বল।
 
বাগেরহাট প্রতিনিধি।
 
নিজের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালাতে বাগেরহাট শহরের অলিতে গলিতে এক বেলা করে চা-কফি বিক্রি করেন‌, বাগেরহাট সদর উপজেলার কচুয়ার মোঘিয়া ইউনিয়নের ছোট আন্ধারমাণিক গ্রামের এক সংগ্রামী তরুণ উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে তিনি সরকারি পিসি কলেজের অনার্স গণিত প্রথম বর্ষের (২০২৩-২৪) শিক্ষার্থী। অভাব-অনটনের সংসারে বাবার চিকিৎসা নিজের পড়াশোনা এবং পরিবারের খরচ মেটাতে তিনি প্রতিদিন বিকেলে কাঁধে নিয়ে বের হন থার্মোফ্লাস ভর্তি চা ও কফি। তার এই কফি শপে কফি তৈরির সব সরঞ্জাম, তার পোশাকের সঙ্গেই আটকানো থাকে।

এর জন্য উজ্জ্বল ব্যবহার করেন, বিশেষ ধরনের একটি জ্যাকেট। সেখানে বুকের সামনে লাগানো থাকে গরম পানির ফ্লাক্স। জ্যাকেটের কোনো পকেটে থাকে কফির পাতা, কোনো পকেটে দুধ, কোনো পকেটে চিনি। জ্যাকেটের এক পাশে আবার লাগানো থাকে কফির কাপ। এভাবে ফেরি করে কফি তৈরির সব সরঞ্জাম শরীরে নিয়ে হেঁটে বিক্রি করেন চা-কফি।
 
উজ্জ্বলের বাবা বিষ্ণুপদ মুখোপাধ্যায় বয়স (৭৫) ছিলেন, তালা-চাবির কাজের কারিগর। এখন বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি আর কাজ করতে পারেন না। মা কাজল রানী মুখোপাধ্যায় গৃহিণী। চার বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মা-বাবার একমাত্র ভরসা উজ্জ্বল। পরিবারের এই দায়িত্বভার নিজের কাঁধে নিয়েই তিনি স্বপ্ন দেখেন পড়াশোনা শেষ করে নিজের অবস্থান গড়ে তোলার।
 
উজ্জ্বল প্রতিদিন বিকেল বাগেরহাট শহরের নূর মসজিদ এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে  ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাগেরহাট শহরের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন, ব্ল্যাক কফি ও দুধ কফি। ব্ল্যাক কফি ৮ টাকা দুধ কফি ২০ টাকা করে বিক্রি করে দিনে লাভ হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এই আয় দিয়েই তিনি চালান নিজের পড়াশোনার খরচ বই-খাতা কেনা টিউশন ফি এবং বাসার বাজার। স্থানীয় দোকানদার ও ক্রেতারাও তার পরিশ্রমও লড়াইকে সম্মান জানিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
 
বাগেরহাট শহরের কসমেটিকসের দোকানদার আল আমিন বলেন, উজ্জ্বল ছেলেটা খুব ভদ্র আর পরিশ্রমী ছোট্ট একটা থার্মোফ্লাস নিয়ে প্রতিদিন হাসিমুখে আসে। আমাদের মতো দোকানদাররা প্রায় সবাই তার কাছ থেকে কফি খাই। তার চোখে মুখে লড়াইয়ের ছাপ দেখা যায় । এত ছোট বয়সে এত দায়িত্ব নেওয়া সত্যিই সাহসিকতার ব্যাপার।
 
শহরের ফলপট্টি মোড়ের সৌখিন কসমেটিকসের  বিপ্লব কুমার বিশ্বাস বলেন, ওর কফির স্বাদ যেমন ভালো ওর জীবন সংগ্রামের গল্পটা আরও অনুপ্রেরণাদায়ক। একজন ছাত্র হয়ে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাজ করা সহজ নয়। আমি চেষ্টা করি নিয়মিত ওর কাছ থেকে কফি নিয়ে কিছুটা সাহায্য করতে।
 
সুরুচি গার্মেন্টসের শেখ মুন্না বলেন, প্রতিদিন দেখি ছেলেটা পরিশ্রম করছে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কফি বিক্রি করছে। পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। এমন ছেলেদের জন্য আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত।
 
চা-কফিপ্রেমী কিপার সাহা বলেন, অনেকেই রাস্তায় কফি বিক্রি করে কিন্তু আসলে এদের মধ্যে উজ্জ্বল আলাদা। সে ভদ্র শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল আমি ওর কাছ থেকে কফি খাই কারণ জানি এতে ওর পড়াশোনার খরচ চালাতে সুবিধা হবে।
 
উজ্জ্বলের বন্ধু জয় হরিচাঁদ মৃধা বলেন, ছোটবেলা থেকেই ও পড়াশোনায় ভালো ওর স্বপ্ন অনেক বড়। কিন্তু পরিবারের অবস্থা দেখে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করাটা ওর বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। তারপরও কখনও অভিযোগ করতে শুনিনি সব সময় হাসিমুখে থাকে। টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য না করতে পারলে ও ভালো বন্ধু হিসেবে পাশ থাকবো ওর।
 
এলাকার এক বড় ভাই প্রণয় মন্ডল বলেন, আমি উজ্জ্বলকে ছোটবেলা থেকে চিনি ও সবসময় পরিশ্রমী ছিল। এখন যখন দেখি রাস্তায় কফি বিক্রি করছে কষ্ট হয় কিন্তু গর্বও হয় কারণ ও হার মানেনি বরং নিজের স্বপ্ন ধরে রেখেই লড়াই করছে।
 
সোহাগ আহমেদ বলেন, বিকেলে পার্কে ঘুরতে গেলে প্রায়ই উজ্জ্বলের কাছ থেকে এক কাপ চা খাই। তবে আজ অবধি জানতাম না, সে একজন শিক্ষার্থী। বিষয়টি জেনে ভালো লাগছে। এখন থেকে আমি তো খাই কফি আরো সবাই কে বলবো যে উজ্জ্বল এর কাছে থেকে কফি খেতে তাহলে ওর বিক্রি কিছু টা হলে ও বাড়বে।
 
কলেজ ছাত্র উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় বলেন, বাবার বয়স সওরের উর্ধ্বে হয়েছে এখন কিছুই করতে পারে না। সংসারের অবস্থা খুব খারাপ। আমি পড়াশোনা ছাড়তে চাই না তাই বিকেলে কফি বিক্রি করি। এই আয় দিয়েই কোনো মতে পড়াশোনার খরচ, বই-খাতা, টিউশন ফি, আর বাসার বাজার চালাই যতটা পারছি লড়ে যাচ্ছি। কেউ কিছু কিনলে শুধু উপার্জন নয় সাহসও পাই আমি চাই বাবা মা বেঁচে থাকতে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে।


আমার কাছে এই রাস্তায় রাস্তায় কফি বিক্রি করা লজ্জা লাগে না কারন, আমি গরিব ঘরের সন্তান। আর বিশেষ করে আমি তো চুরি ডাকাতি করে খাচ্ছি না এই জন্য আমার কাজ নিয়ে আমি গর্বিত। মাঝে মাঝে একটু কষ্ট হয় তা মানিয়ে নিয়েছি অনেক লোক আছে বন্ধু বান্ধব দেখে হাসাহাসি করে আসলে লজ্জা করলে তো আর আমার পেট চলবে না।আর আমি সামনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না।এই কারনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করে বিক্রি করি।


আমি এই ১৫ দিন হলো এই কফি বিক্রি করা শুরু করছি কারন, আমার বাবাকে আর কষ্ট দিতে চাই না সেই ছোট্ট বেলা থেকেই বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছু করছেন বড় করছেন শেষ বয়সে এসে যদি এখন ও কাজ করে খেতে হয় তাহলে এর চেয়ে লজ্জার আমার কাছে কিছু নেই। আর আমি পড়াশোনা ও ছাড়তে চাই না কারন আমি বড় হবো। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবো।

এছাড়া, আমি মাটির তৈরি প্রতীম বানাতে পারি এই প্রতিমা তো সব সময় তৈরি করা হয় না। তাই এই রাস্তায় রাস্তায় চা কফি বিক্রি করি জানি না কত টা সাফল্য অর্জন করতে পারবো কিন্তু আমার মনবল আছে আমি সব কিছু পেরিয়ে সামনের দিকে পৌঁছে যাব।
 
সরকারি পিসি কলেজের গণিত বিভাগের ডিপার্টমেন্ট প্রধান রফিকুল ইসলাম বলেন, উজ্জ্বল আমাদের কলেজেরই ছাত্র ও অনেক মেধাবী।আমি ওর সংগ্রামের কথা শুনেছি। সত্যি বলতে এই ধরনের ছেলেরা সমাজের জন্য উদাহরণ। আমরা কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাকে সহযোগিতার বিষয়টি বিবেচনা করবো। তার মতো সংগ্রামী তরুণদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।  আমরা যদি ওর পাশে এখন না দাঁড়ায় তাহলে দাঁড়াবে কে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে ওর পাশে সব সময় বাবা-মায়ের মতন পাশে থাকবো।

উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, সংসার আর স্বপ্ন একসাথে কাঁধে নিয়েও এগিয়ে যাওয়া যায় যদি থাকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম। সমাজে এমন তরুণরা শুধু নিজের জন্য নয় অন্যদের জন্যও হয়ে ওঠে আলোর দিশারি।





 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ